Spread the love

-আহমদ রাজু

বাজারের উত্তর পার্শ্বে হঠাৎ হৈ চৈ শুরু হয়েছে। উৎসুক লোকজন সেদিকে ছুটছে, কী হয়েছে- কেন হয়েছে জানার জন্যে। সাধারণত হাট বাজারে অধিকাংশ সময় কোলাহল থাকে। এর মানে এই নয় যে, সে কোলাহল উচ্চ শব্দে রূপ নেবে। তবে কী খারাপ কিছু ঘটেছে?

সেলস্ ডিপার্টমেন্টে চাকুরী আমার। এক কথায় সেলসম্যান। শুক্রবার কোন রকম ছুটি পেলেও অন্য দিনগুলোতে নাকানি চুবানি খেতে হয়। যদি টার্গেট পূরণ না করতে পারি তাহলে বেতন সীটে আমার অবস্থান তলানীতে গিয়ে ঠেকবে। যা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি আর দৈনন্দিন জীবন ধারণের বাস্তবতায় নিজেকে মানিয়ে নিতে নাভিশ্বাস চারদিক। সেই সাথে চাকুরীজীবীদের উপর মহলের চাপতো রয়েছেই। এ মাসে দশ লাখ টার্গেট তো পরের মাসে বারো লাখ। গায়ের ঘামকে পাত্তা না দিয়ে প্রথম টার্গেট পূরণ করতেই বড় কর্তা শুকনো ধন্যবাদ দিয়ে পরের টার্গেটের দিকে মন দিতে বলেন। কখনও যদি কপালের অনাকাক্ষিত ভাঁজ তার নজরে আসে তখনি তিনি চাকুরী থেকে ইস্তফা দিতে বলেন। যা ভাবা আমাদের মতো ছা পোষা মানুষদের জন্যে একদমই অস্বাভাবিক। এমনি দোলাচলে দুলে দুলে চলছে- চলবে আমাদের জীবন।

বন্ধের দিন বলে আমি সকালে বাজারে গিয়েছিলাম টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা করতে। শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটি অথচ সব শুক্রবারই আমার বন্ধের জন্যে বরাদ্ধ নয়। আর শনিবার? সেতো কল্পনার বাইরে। কালেভদ্রে দু’একটা শুক্রবার কপালে জোটে। বাকী শুক্রবারগুলো অর্ডার নেবার কোন তাড়া না থাকলেও দক্ষতা বৃদ্ধির নামে সেমিনার- বৈঠকে আমাদের সবাইকে আটকিয়ে রাখে। দুপুরে ভাল খাবার দেয় ঠিকই তবে তা খাঁচার পাখির সামনে কুর্তা বিরিয়ানি দেবার মতো। যে খাবারে কখনও তৃপ্ত হতে পারিনা আমি। ছেলে দুটো আমার চেহারাই ভুলে গেছে। ভোরে যখন বাড়ি থেকে বের হই তখন তারা সবাই ঘুমে। মাঝ রাতে যখন বাড়ি ফিরি তখনও তারা ঘুমে।

যাইহোক, কেনাকাটা শেষ করে হাঁটতে হাঁটতে মাছ বাজারের দিকে যাই। মাছের চান্নি বাজারের শেষ মাথায় দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ সিগারেট ফ্যাক্টরীর কোল ঘেঁষে যে রাস্তাটা জঙ্গলবাঁধাল স্কুলে চলে গেছে তার পাশে। জেলা পরিষদ রাস্তাটাকে সম্মুখে রেখে ছোট ছোট দোকানঘর তৈরি করে দিয়েছে। ঘরগুলো তড়িঘড়ি নামমাত্র মূল্যে বরাদ্দ হয় সামাজিক ব্যক্তি নামধারী কিছু দলীয় নেতার নামে। তারা নিজেরা ব্যবহারতো করেইনি বরং নিয়ম নীতির তুয়াক্কা না করে চড়া মূল্যে অন্য ব্যক্তির কাছে বাৎসরিক চুক্তিতে ভাড়া দিয়েছে। এই ঘরগুলোর পাশেই মাছের চান্নি। সব মিলিয়ে ত্রিশটিরও বেশি দোকান সেখানে বসে নিয়মিত। দোকান বেশি হলে কী হবে, যেসব মাছ তারা বিক্রি করে তার অধিকাংশ আমার পছন্দ হয় না। বাজার এখন নকলে ছেয়ে গেছে। মাছে ভাতে বাঙালি বললেও সেই মাছও এখন ভ্যাজাল পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। শিং, কৈ, মাগুরসহ খাল বিলের দেশি মাছ চাষ হচ্ছে দেদারছে। চাষের মাছ বিক্রি হয় খাল- বিলের মাছ বলে। উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের যে স্বাদ তার ছিঁটে ফোঁটাও এ মাছে পাওয়া যায় না। চাষের মাছ তিন’শো টাকা কেজি হলে বিলের মাছের কেজি ছয়শো। তবুও তার চাহিদা আকাশ সমান। এক কেজির জায়গায় এক পোয়া কিনলেও তৃপ্তি পাওয়া যায়। মাছ ব্যবসায়ীরা দেশি বলে চালানোর চেষ্টা করলে যে জানে সে তাদের ফাঁদে পা দেয় না। আর যে জানে না সে বিলের মাছ ভেবে বেশি দামে নিয়ে বাড়ি যেয়ে হা-হুতাশ করে।

আমি মাছ বাজারে ঢুকে ঘাড় ঘুরাতেই দেখি রতন খুড়োর দোকানের সামনে অনেক মানুষের জটলা। কৌতুহলবসতঃ সেদিকে এগিয়ে যাই। ভীড়ের ভেতরে দাঁড়িয়ে মজিদ মাতব্বর উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘তুই দুকানেরতে আগে বার হয়ে আয়; তোরে দেহাচ্ছি। শালার শুয়োর- জানোয়ার; আমার সাথে ফাজলেমি করিস? এই শালা তোরে সাহস দেছে কিডারে? পাড়ায়ে নাড়ি বার করে দিবানে।’

জটলার মধ্য থেকে খালঘাটের রহিম কবিরাজ বলল, ‘সামান্য কামারের সাহস হয় কিরাম করে- মাতবারের কাচির ধার উল্টো কাটে দেয়!’

উত্তর নগরের জমশেদ বলল, ‘ওর তো মেলা সাহস হয়ে গেছে দেখিতিছি! তুই ঘরেরতে বার হ’ দেহি তোর কিরাম সাহস।’

মজিদ মাতব্বর বলল, ‘আমার সন্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সাহস তুই কনে পালি? এই তুরা ঘরেরতে ওরে বার করে নিয়ে আয়।’

আমিতো অবাক। একজন বয়স্ক মানুষের সাথে এ কী ব্যবহার! যতই সে অপরাধ করুক না কেন, তার সাথে এমন ব্যবহার আশা করা যায় না। তবুও আমি নীরব। এখানে- এই বাজারের ভেতরে আমার কথা শোনার মত কেউ নেই। বরং কিছু বলতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

বাজার কমিটির সভাপতি তালেব শেখ পাশেই ছিল। কোলাহল দেখে সেখানে এগিয়ে এসে বলল, ‘কাকা তুমি এট্টু থামো দি। আমি দেখতিছি; অতো উত্তেজিত হয়ে না।’

‘উত্তেজিত হবো না! ও কাজটা কল্লো কী?’

‘আর তুমিও খুড়ো! এত বছর কাজ করতিছো, ইরাম এট্টা সব্বনাশের কাজ করলে কী করে? আচ্ছা, কারো বুদ্ধিতে করো নিতো? তুমার সেই বুদ্ধিদাতা কিডা তাই কও দিনি?’

‘ওরে আগে ঘরেরতে বার করে নিয়ে আসতি হবে। শালারে পাড়ায়ে নাড়ি বার করে দিলি আমার মনের জ্বালা মেটপেনে।’

‘তুমি ইট্টু থামোতো কাকা, বুড়ো মানুষ, আমি দেখতিছি।’

কথা শোনে না মজিদ মাতব্বর। সে রতন কামারকে মারার জন্যে তার দোকান ঘরের ভেতরে ঢুকতে গেলে উপস্থিত কিছু লোক তাকে ঠেকিয়ে রাখে। আর যাই হোক, সে বয়স্ক মানুষ। গায়ে হাত দেওয়া একদম বেমানান। মজিদ মাতব্বর আবদ্ধ অবস্থায় চিল্লিয়ে বলে, ‘শালা শুয়োরের বাচ্চা, তোর সাহস কতো? শুধু বাঁচে গেলি, আমি দেশের আইন ভাঙতি পারবো না তাই। তা না হলি তোর দুকানে ঢুকে চ্যাচ চ্যাড় করে বাইরি টানে আনতাম। কী কবো যে, তোর দুকানের ভিতরে আমি ঢুকতি পারতিছি নে।’

রতন গত ষাট/পয়ষট্টি বছর এখানে কামারের কাজ করছে, টকবগে যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়েছে অথচ কোনদিন তাকে নিয়ে কথা হয়নি। তার কাজে সবাই সন্তুষ্ট। এককথায় এলাকার জনপ্রিয় কামার। বাবার পেছনে পেছনে যেদিন থেকে বাজারে আসা শুরু করলো তখনও না। সে কিছু না বলে আপন মনে তার কাজ করে চলেছে। যেন কিছু হয়নি।

‘শাহিদ দেহিচাও ওর সাহস কতো। এত কতা কচ্ছি গায় মোটে লাগাচ্ছে না।’ আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলল মজিদ মাতব্বর।

মজিদ মাতব্বরের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের একটা যোগসূত্র আছে সেই দাদার বাবার আমল থেকে। দাদার সাথে মজিদ মাতব্বরের বেশ দহরম মহরম ছিল যা আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। দাদা মারা গেছে অনেক বছর আগে অথচ দাদার সাথে আমার কিছু স্মৃতি আজও আমার হৃদয় কন্দরে অমলিন। মজিদ মাতব্বরের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘দাদা, এখনতো বকাবকি করে কোন কাজ হবে না। কীভাবে সমাধান করা যাবে সে ব্যাপারে ভাবতে হবে।’

‘বগাবগি নারে ভাই, আমারতো মাথা খারাপ করে দেছে ও।’

তালেব শেখ বলল, ‘আচ্ছা কাকা মাথা ঠাণ্ডা করে কওদিনি কি হয়ছে?’

দোকানের সামনে লম্বালম্বি পাতানো বেঞ্চে বসে মজিদ মাতব্বর। সে ক্ষণেক দম নিয়ে বলল, ‘আরে বাপুরে কী কবো কও? কালকের আগেরদিন সহালে দুডো কাচি ওরে দিয়ে কলাম, খুড়ো ঠিক মতো ধার কাটে রাহো; আমি সন্ধেই নিয়ে যাবানে।’

‘তা তুমার কাচি তুমিতো দিবাই। ধার না থাকলি ধার দিতি হবে না?’ বলল তালেব শেখ।

‘এই জাগাইতো সমস্যা। কাচি আমি সন্ধেই নিয়ে গিছি সত্যি। টাহা আশি চাইলো, তাও দিছি। কালকে সকালে আমি মাঠে যায়ে যেই ধানের গোড়ায় পোচ দিছি অমনি সড়াত করে কোলের দিকি চলে আসলো। একবার দুইবার না; বার বার। আমিতো বুঝতি পারলাম না কী হচ্ছে। যতই পোচ দিই কোন কাজ হয় না। কী মনে করে সামনের দিকি ঠেলা দিলিই কাচি আটকে যায়! আমি ভাবলাম যে, জেন ভূতির কাজ কিনা! পরে কাচি চোহির সামনে আনে দেহি ধারইতো উল্টো কাটা। উল্টো দিকি ঠেলা দিয়ে কী আর ধান কাটা যায়? ওই শালার বুড়ো শয়তানী করে উল্টো ধার কাটে দেছে। এট্টা হলিতো হতো- দুডো কাচিরই একই অবস্থা। হাটেরতে চারজন কিশেন নিয়ে গিছি। তাগের একজনের কাছে কাচি ছিল না। আমার দুডো কাচির এট্টা তারে দিই। সেওতো কাটতি পারিনি। হয় নাই এরাম করে?’ রাগে শরীর কাঁপে মজিদ মাতব্বরের। সে জোরে জোরে শ্বাস নেয়।

‘আমার জোনের দাম দিবি শালার হারামি।’

তালেব শেখ বলল, ‘তুমি থামো কাকা; ব্যবস্থা এট্টা হবেনে।’

‘কী ব্যবস্থা হবে? ওরে আগে মারে নিতি দেও। এই ছাড় দিনি।’

‘অত উত্তেজিত হয়ো না। বাজারের এট্টা নিয়ম কানুন আছে। তুমি শান্ত হও, আমি দেখতিছি। আর যদি মনে করো ওরে মারলি তোমার সমস্যা সমাধান হবেনে তালি আমি আর কি কবো কও।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি বসলাম। তুমরা কি করবা করো।’ বলে থপাস করে বেঞ্চের ওপর বসে পড়ে মজিদ মাতব্বব।

এতক্ষণ চুপ থেকে নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল রতন কামার। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে দেখে সে তার জায়গা থেকে হাঁটুর ওপর দুই হাতের ভর দিয়ে উঠে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মজিদ তো প্রথমেরতে আমার দোষ দিয়েই যাচ্ছে। নিজির দোষতো একবারও কয়নি?’

‘এই শালার শুয়োর আমার দোষ কী রে? কাচিতি ধার কাটিচির তুই, শয়তানি তো তোর।’ মজিদ মাতব্বর উত্তেজিত হয়ে রতন কামারের দিকে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিলে তালেব শেখ তার হাত ধরে বসিয়ে দেয়।

‘চালন খোঁজে সুইয়ের ফুটো। নিজির ফুটোগুলো দেহার চিষ্টা করো।’ বলল রতন কামার।

‘এই তুই কি কচ্ছির? কিছু খাইছির ফাইছির নাই বুড়ো বয়সে? কওদিনি তালেব, কিসির মদ্দি কি কচ্চে?’

‘আমি যা কচ্ছি ঠিকই কচ্ছি। যদি তুমার কাচিতি ধার উল্টো কাটা হয়েই থাহে তালি সিডা তুমার দোষে।’

রতন কামারের মনের মধ্যে কী আছে তা বুঝতে পারে না উপস্থিত কেউ। কী এমন ভুল মজিদ মাতব্বরের, যার জন্যে তার কাচিতে ধার উল্টো কাটা হলো? মজিদ মাতব্বর নিজের মনের কাছে প্রশ্ন করে কোন উত্তর পায় না। সে কী উল্টো ধার দেওয়া কাচি দিয়েছিল? নাকি বলেছিল উল্টো ধার কাটতে? গত বছর এই কাচি দিয়েই ধান কেটেছিল স্পষ্ট মনে আছে মজিদ মাতব্বরের। বয়স এমন কিছু হয়নি যে স্মৃতি থেকে মুছে যাবে সেসব কথা। তাহলে কেন কী কারণে এমন কাণ্ড ঘটালো রতন কামার? সে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে পারে না। বলল, ‘তোর এহনই কতি হবে, আমার ভুল কী? না কতি পারলি তোরে কিন্তু আমি ছাড়বো নানে। বুড়ো মারে যদি জেলে যাতি হয় তাও যাবানে।’

দেশের বর্তমান আইন বেশ কড়া। বিশেষ করে হিন্দুদের সাথে কিছু ঘটালেই তাদের অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। কে কাচিতে ধার কাটলো আর কে কাটালো তার বাছ বিচার করবে না। তখন বাজার কমিটিই পালিয়ে বাঁচতে পারবে কিনা সন্দেহ। অবস্থা অন্যদিক গড়াচ্ছে বুঝতে পেরে তালেব শেখ বলল, ‘এহন কিছু কতি হবে না। তুমরা দুইজনে এখনকার মতো ক্ষ্যান্ত দেও। আজ তো শুক্কুরবার, রবিবার ইশার নামাজের পরে বকুল তলায় বসি।’

‘রবিবার বেশি দেরি হয়ে যায় না?’ প্রশ্ন মজিদ মাতব্বরের।

‘খোলে তো মাত্তর এট্টা দিন। সবাইরেতো পাতি হবে। আর যদি মনে করো, সব বাদ দিবা তালি অন্য কথা।’

‘তুমার কি মাথা খারাপ? শোন, আমার মাতব্বারী নেই ঠিক, তাই বলে নামের শেষেরতে তো আর মাতব্বর নামডা বাদ যায়নি। গরীব হতি পারি- কাচি কিন্তু বেঁচে খাইনি এহনও।’

তালেব শেখ মজিদ মাতব্বরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘শোন কাকা, রতন খুড়ো হিন্দু মানুষ; যতই আমাগের আপন ভাবিনে কেন আইন কিন্তু কবেনে সংখ্যালঘু। তুমি ওর সাথে পারবা না। আইন আদালত সব ওর পক্ষে যাবেনে। দেখলে না, কয় বছর আগে মালো পাড়ায় কয়জন আগুন ধরালো আর বিপদে পড়লো কতো লোকে।’

‘যারা ধরাইলো তারাওতো মুসলমান। তারা ইরাম অধর্মের কাজ করতি গেল ক্যান?’

‘তুমি ঠিকই কইছাও। তয় যারা এই কাজ করিছিল তারা সবাই সাজা পায়ছে আমার বিশ্বাস হয় না। নির্দোশীরাও অনেকে সাজা খাটতেছে।’

‘‘ওই যে, পাপী মরে দশ ঘর নিয়ে; কথায় আছে না।’

‘সে তুমি কতিই পারো। তবুও আমার অনুরোধ আর এট্টু ভাবে দেহো।’

‘শোন, ওই মালোপাড়া আর আমার বিষয় এক না। ও যে কাজটা করেছে তাতে আমার মান সন্মান সব নষ্ট হয়ে গেছে। সবাই জানে গেছে, আমার কাচিতি উল্টো ধার কাটে দেছে। এর চায়ে লজ্জার আর কিছু আছে; কওদিনি?’

‘তালি আর কি; রবিবারে বসি। বসলি এট্টা ফয়সালাতো হবেনে।’

‘তাই বসো। ওরে এট্টা উচিত শিক্ষা দিতিই হবে। ওর কত বড় সাহস, আমার কাচিতি উল্টো ধার কাটে দেয়।’ বলে বেঞ্চ থেকে উঠে বাড়ির দিকে রওনা দেয় মজিদ মাতব্বর।

রতন কামারকে উদ্দেশ্য করে তালেব শেখ বলল, ‘খুড়ো, তালি রবিবার রাত্তিরি ওই বকুল তলাই বসতিছি। তুমি যেন আবার আসতি ভুল করে না।’

‘আমি ভুল করবো নানে। আর আগেও ভুল করিনি।’

এত আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে পেলো রতন কামার? যার বিরুদ্ধে শালিস বসবে তার চোখ মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছিঁটেফোটাও খুঁজে পায়না তালেব শেখ। বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুমার কাজ করো। আমারতো আবার সবাইরে ডাকতি হবে।’ সে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘শাহিদ তুমার খবর কী? সেই কোম্পানীতে আছো নাকি?’

‘হ্যা ভাই, সেখানেই আছি।’

‘ঢাকাই আর যাবা ঠাবা নাকি?’

‘তেমন কোন ইচ্ছা নেই।’

‘নতুন জাগায় বেতন ঠিকমতো পাওতো?’

‘ভাই, যা পাই তাতে চলে যায়; অতিরিক্ত থাকেনা এই যা।’

‘তা হোক, বিদেশের নলা মাছের চাইতে দেশের পুটিও ভাল।’

‘এই জন্যেইতো এখানে আঁকড়ে পড়ে আছি।’

‘শালিসির দিন আসো। শুনিচাওতো খটনাডা কী? তয় এর ভিতরে কিছু এট্টা আছে বলে মনে হচ্ছে। তা না হলি রতন খুড়োর মনে এট্টুও চিন্তা নেই কেন?’

বললাম, ‘কার মনে কী আছে তা কে-ইবা বলতে পারে।’

‘সে তার মনের মধ্যি যা খুশি লুকোয়ে রাখুক। বাজারের মধ্যিতো এসব করলি চলবে না।’

‘সে ঠিক। রতন খুড়োর অবশ্য ভুল হয়েছে। আর এদেরও একজন বয়স্ক মানুষকে সম্মান দেখানো উচিৎ।’

‘দেহা যাক রবিবারে কী হয়।’ বলে হাঁটতে হাঁটতে তালেব শেখ ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি বাজারের প্যাকেট নিয়ে যখন বাড়িতে ফিরে আসি তখন সূর্য মাথার ওপরে।

কথাটা প্রচার হতে মোটেও সময় লাগেনি। বাজার থেকে মোড়ের মাথার চায়ের দোকান, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, খেয়াঘাট, মুন্সীদের সাঁন বাঁধানো পুকুরঘাট সবখানে রটে গেছে কাচি ট্রাজেডি। মাত্র একদিনের ব্যবধানে একটা কথা এতটা ছড়িয়ে পড়তে পারে তা নিজে উপস্থিত না থাকলে বোঝানো মুষ্কিল। বিভিন্ন কথার উপমায় রূপ নিয়েছে কাচি ট্রাজেডি। একজন আরেকজনকে কটু কথা হিসাবে বলে, ‘মজিদ মাতব্বরের মতো মানুষির কাচিতি যদি উল্টো ধার কাটা হয়, আর তুই তো কোন নাতাড় মজিদ।’

এসব কথা মজিদ মাতব্বরের কানে গেলে সে রেগেমেগে অস্থির। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রতন কামারকে শালিসের ভেতরে মারবেই। তাতে জেল ফাঁস যা হয় হবে। তালেব শেখ অবশ্য বলেছিল, দেশের আইন আদালতের কথা। বর্তমানে যে মানষিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে সে অতিবাহিত করছে তাতে আইন আদালতকে যে কোন সময় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে প্রস্তুত। ধান কাটা বন্ধ। এর একটা বিহীত না করা পর্যন্ত কিছুই করবে না বলে পণ করেছে। হাট থেকে আনা দিনমজুরদের দুদিন বসিয়ে খাওয়াচ্ছে। তারা দাবী করলে মজুরীও দিতে হবে। কাজ বন্ধের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। মজিদ মাতব্বর নিজে ইচ্ছে করেই তাদের বসিয়ে রেখেছে। সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। সারা জীবনের সঞ্চয়, দুই কাচিতেই উল্টো ধার কেটে শেষ করে দিয়েছে রতন কামার। নিজের কাছে মনে হয়, তার মান সম্মান আর একটুও অবশিষ্ট নেই।

বকুল গাছের সামনে জড়ো হয়েছে বাজারের শ’খানেক দোকানদার। মাটিতে বিছানো চটের ওপর অনেকে বসে থাকলেও কেউ কেউ আবার তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দু’একজন ক্রেতা যে নেই তা নয়; আছে, তবে তার সংখ্যা অতি নগন্য। তার মধ্যে আমিই হয়তো ক্রেতা-বিক্রেতা কিছু নই। ডিউটি শেষ করে যত রাতই হোক, নিয়মিত বসুন্দিয়া পৌঁছে আলামিনের চায়ের দোকানে সিগারেট-চা খেয়ে তারপর বাড়িতে যাই। যতই ছোট জিনিস কিনিনা কেন, এ দিক দিয়ে অবশ্য ক্রেতা বলা যেতেই পারে। চা খেতে খেতে মনে পড়ে, কাচি ট্রাজেডি নিয়ে আজ শালিস হবার কথা। দু’আঙ্গুলের মাঝের সিগারেটে বার কয়েক টান দিয়ে ওখানে ফিল্টারটা ফেলে দিয়ে দ্রুত চলে যাই বকুল তলায়। মাঝে মধ্যে আলম দোকান বন্ধ করে আমার জন্যে চায়ের দোকানে এসে অপেক্ষা করে। আজ আসেনি। কেন আসেনি সেটা অজ্ঞাত। প্রায়ই এমন ঘটনা সে ঘটায়, যে কারণে আজ তাকে না পেয়ে মোটেও বিস্মিত হইনি। তবে শালিসে সে যায়নি এটা একেবারে নিশ্চিত। কারণ, সমাজ সামাজিকতা থেকে সে সবসময় নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। সারাদিন হাড় ভাঙা খাঁটুনির পর ফেরার পথে নিয়মিতই ভাবি চায়ের দোকানে যেয়ে আলমের সাথে চা- সিগারেট খেয়ে একসাথে বাড়ি ফিরবো। অথচ অনেক দিনই সে নিজের মতো বাড়ি চলে যায়, কিছু না জানিয়ে। এটা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। আমি তার কোন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিনা কখনও। সে যদি নিজের থেকে না বোঝে তাহলে তাকে বৃথা বোঝানোর চেষ্টা করার মানেই হয় না। এমনিতে আমি তার বন্ধু কিংবা ভাই এমন নয়। তবে সিগারেট ফ্রেণ্ড তো বলতেই পারি।

সামনে সারি দিয়ে রাখা তিনটি চেয়ারে বসে বাজার কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারী আর সবার শ্রদ্ধেয় সোবহান শেখ। তিনি বাজার কমিটির কেউ না হলেও তাকে সবাই মানে- সম্মান করে। মজিদ মাতব্বর প্রথমে তার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলে। সব কথা শেষ হলে তালেব গাজী বলল, ‘যহন বগাবগি হয় তহন আমি সেই জাগায় ছিলাম। আসলে ব্যাপারডা সামান্য। বয়স্ক মানুষ, হয়তো ভুল হয়ে গেছে। আমি চাইলাম তহনি শেষ হয়ে যাক। মজিদ কাকার কাচিতি রতন খুড়ো আবার ধার কাটে দিক। তালি তিন দিন কিশেনের বসে থাকতি হতো না। পরিবেশ অন্যদিকে মোড় নিচ্ছিল বলে আজকে বসা। এখন আপনারা সবাই আছেন, সিদ্ধান্ত দেন কী করা যায়।’

সামনে ভীড়ের মধ্যে থেকে একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি কি এট্টা কথা কবো?’

তালেব গাজী বলল, ‘বলেন।’

‘বাজারে যে এত অন্যায়, অধর্ম হচ্ছে তা কারো নজরে পড়তেছে না। কনে রতন খুড়ো ভুল করে কাচিতি উল্টো ধার কাটে দেলো আর তাতেই শালিস বয়ছে! এক সের চাল কিনলি এক পুয়া ঝিল পাওয়া যায়, নুন কিনলি তাতে বালি থাহে, নারকেল তেল কিনে বাড়ি নিলি বাড়িরতে বগে, তাতে নাকি সয়াবিন তেল মিশেনো। তিন টাহার মাল কোন কোন দিন তের টাহায় বিক্রি হচ্ছে। এগুলো না ধরে কনে ধার উল্টো হয়ে গেছে তাতেই এত বড় শালিস!’

‘আজকে যহন শুরু হয়ছে, এর পরেরতে আপনারা অভিযোগ দিলি আমরা বসপো।’ বলল তালেব গাজী।

বাজার কমিটির সেক্রেটারী গোলাম শেখ বলল, ‘রাত অনেক হয়ছে। সবারই কাজ আছে। দ্রুত সমাধান দরকার।’

সোবহান শেখ বলল, ‘সব কথা শুনে বুঝলাম, রতন কামার অন্যায় করেছে। সে বুঝে হোক আর না বুঝে হোক কাজটা করে ফেলেছে। যেহেতু আমাগের সবার এক এলাকায় বাড়ি, সকাল হলিই এ ওর মুখ দেহি। তাই আমার মনে হয়, রতন খুড়ো ভুল করেছে। তার ভুল স্বীকার করা উচিৎ।’

মজিদ মাতব্বর উঠে দাঁড়িয়ে খেঁকিয়ে ওঠে, ‘অসম্ভব, ওই বুড়ো ভাড় আমার মান সন্মান সব নষ্ট করে দেছে। দশ গ্রামে ছড়ায়ে গেছে এই কথা। কত্ত বড় সাহস, আমার কাচিতি ধার উল্টো কাটে দেয়! আমিতো এহন মুখই দেহাতি পারতিছি নে।’

মজিদ মাতব্বরের কথায় তার পক্ষের সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সমস্বরে চিল্লাতে থাকে। তারা রতন কামারকে মারবে বলে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে। সবার হাতে একটা করে বাঁশের লাঠি; যার একটা বাড়িই রতন কামারের জন্যে যথেষ্ট। তালেব গাজী তাদের থামাতে চেষ্টা করে। বার বার থামতে বললে খুব একটা কাজ হয় না। বরং তারা এগিয়ে যায় রতন কামারের দিকে। উপায়ন্তু না দেখে সোবহান শেখ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘থামেন; আপনারা কি সবাই পাগল হলেন? আপনারা যদি বিচার করবেন তাহলে আমাদের ডাকেছেন কেন? কী দরকার আমাদের ডেকে অপমান করার? আসলে আপনারা রতন কামাররে অপমান করতেছেন না, অপমান করতেছেন আমাগের।’ কথাটা শুনে যে যার জায়গায় বসে পড়ে।

রতন কামারকে উদ্দেশ্য করে সোবহান শেখ বলল, ‘রতন তুমার কি কিছু কওয়ার আছে?’

রতন কামার একপাশে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। সে অপেক্ষাকৃত ভীড় থেকে সামনে এসে বলল, ‘হ্যায় আছে।’

‘কও, তুমি কি জন্যি এই কাজ করিছো খোলসা করে কও।’

‘আমার এট্টাই প্রশ্ন-এট্টাই উত্তর।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে. তাই কও।’ বলল তালেব গাজী।

‘প্রশ্নডা মজিদ মাতব্বররে করবো।’

‘কই মজিদ কাকা? তুমি এট্টু সামনে আসো।’ বলল তালেব গাজী।

মজিদ মাতব্বর রতন কামারের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সেখান থেকে বলল, ‘এই যে আমি এইজায়গায়।’

রতন কামার বলল, ‘মজিদ মাতব্বর, তুমার কি মনে আছে গত বছর এই জোষ্টি মাসে তুমার কাছতে আমি দুই সের আম নিহিলাম।’

মজিদ মাতব্বর বলল, ‘হ্যা নিহিলে; তাতে কী হয়ছে?’ চোখে তার আগুনের ফুলকি।

‘তুমি কি কইলে, আম দারুন মিষ্টি?’

সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে মজিদ মাতব্বর। বলল, ‘সেতো অবশ্যই। আমার আম এই তল্লাটে কিডা না খায়ছে।’

‘মিথ্যে কথা। তুমার সেই আমগুলো সব চুপো (টক) ছিল।’

মজিদ মাতব্বরের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। অন্য সময় তার হম্মিতম্বিতে সবাই মুখে কুলুপ এটে থাকলেও এখন নিজেই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে!

আসলেইতো তার আমগুলো টক ছিল। আমি নিজেও গত বছর এক শুক্রবারে তার কাছ থেকে পাঁচ কেজি আম কিনে সেকি বিপদে। টকটকে রঙের রসালো চেহারা। মাতব্বরের নিজের গাছের আম; আর যাই হোক খারাপ হতে পারে না। তাছাড়া আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় যখন, তখন ঠকাবে না এ দৃঢ় বিশ্বাস আমার ছিল। বাড়ি নিয়ে মুখে দিয়ে দেখি সেকি টক! শেষে উপায় না দেখে সব আম দিয়ে আমশক্ত বানিয়েছিল গিন্নি। পরে অবশ্য ওনার সাথে অনেকবার দেখা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে যেয়েও পারিনি দুটো কারণে। এক, লোকটি বয়স্ক, মুখের ওপর টক আমের কথা বললে লজ্জা পাবে হয়তো। দ্বিতীয়, সে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি। পাছে আমের কথা বলে নিজেই বিপদে না পড়তে হয়। যতই আত্মীয় হোক না কেন, এখনতো আবার দলবাজি-গলাবাজির ক্ষমতা বেশি! বিষয়টি আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ রতন খুড়োকে সকল ভয়-ডরকে উপেক্ষা করে তার মুখোমুখি কথা বলতে দেখে নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিই। যা আমি করতে পারিনি সে কাজ করলো একজন বয়স্ক ব্যক্তি! তবে এই শালিসী বৈঠকে এসব কথা কেন তুলছে? আমের সাথে কাচিতে ধার কাটার কী সম্পর্ক তা আমার বোধে আসে না।

আমার ভাবনায় ছেদ টেনে রতন কামার বলল, ‘মজিদ মাতব্বর, তুমি সেদিন মিষ্টি আম কয়ে আমারে যিরাম চুপো আম দিহিলে সেইরাম তুমার কাচিতি আমি সিধে ধারের বদলি উল্টো ধার কাটে দিছি।’ কথাটা শুনে উপস্থিত কেউ কেউ হো হো করে হেসে উঠলেও তার প্রতিবাদের ভিন্নতা দেখে অনেকে হতবাক হয়ে যায়।

One thought on “শোধ”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights