নিয়ন আলোয় স্বপ্নচোখনিয়ন আলোয় স্বপ্নচোখ

-আহমদ রাজু

সুন্দরবন এক্সপ্রেসটা পার হবার সাথে সাথে আবারো সুনসান নীরবতা নেমে আসে সিঙ্গিয়া রেলস্টেশনে। বহু বছর থেকে সকাল-সন্ধ্যায় একটা করে লোকাল ট্রেন থামে এখানে। দূরপাল্লার কোন ট্রেন থামার নামও করে না।

একসময় প্রতিটা ট্রেন থামতো। দিনরাত যাত্রীদের ভীড়ে সমস্ত এলাকা সজাগ থাকতো; যা এখন অতীত। এখন দিনের বেলা হাতে গোনা কয়েকজন যাত্রী উঠানামা করে। সন্ধ্যার পর স্টেশন মাষ্টার, লাইনম্যান আর একজন পাগলী ছাড়া অন্য কাউকে চোখে পড়ে না সচরাচর।

সন্ধ্যার পর হাতে গোনা দু’একজন হাটুরে মানুষ স্টেশনের মাঝ বরাবর রাস্তা দিয়ে যায়। গ্রামের মানুষগুলো যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছাবার চেষ্টা করে। এমনিতে এই এলাকাটাকে তারা খারাপ বলে জানে। কেন খারাপ তার সদুত্তর কেউ দিতে পারে না। সবার এক কথা, এলাকাটা ভাল না।

গভীর রাত অবধি জুয়ার আসর বসে স্টেশনের পেছনের কলাবাগানে। বসুন্দিয়া মোড়ের কাঠ ব্যবসায়ী বাবর আলী, মাতব্বর জব্বার মুন্সী, বাজার কমিটির সদস্য রফিক তালুকদার আর দর্জি রণজিৎ পাল এই চারজন নিয়মিত রাতে উপস্থিত হয় জুয়ার আসরে। সেখানে শুধু যে রাতে জুয়ার আসর বসে কিংবা এই চারজনই সদস্য তা নয়। সারাদিন কিছু না কিছু হয়-ই। তবে এই চারজনের কথা আলাদা। তারা সম্মানিত ব্যক্তি বলে দিনের বেলা তাদের টিকিটিও দেখা যায় না এ এলাকায়।

গাঁজা টানা, তাড়ি খাওয়া, তাস খেলা জাতীয় বিষয়গুলোর উদ্যোক্তা অবশ্য উঠতি মাস্তান, মাতব্বর শ্রেণী কিংবা বখাটেরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি তাদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো।

বাগানের ভেতরে যাবার সরাসরি কোন পথ নেই। নিজেরাই ঝোপ জঙ্গল ভেঙে পায়ে চলা সরু পথ তৈরী করেছে শুধু তাদের জন্যে; যে পথ সম্পূর্ণ আলাদা। স্বাভাবিক পথের সাথে সে পথের কোন সম্পর্ক নেই বললেই চলে।

যদি অতীতের মত এই স্টেশনটা সচল থাকতো, যদি বিভূতি দাস মিষ্টি আর সন্দেশ ভরা সেই কাঁচের বাক্স মাথায় নিয়ে ফেরি করে বিক্রি করতো প্লাটফর্মের এমাথা-ওমাথা; তাহলে হয়তো উন্নয়ন ঘটতো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জীবনের। সৃষ্টি হতোনা এখানকার অন্ধকার সমাজ।

রুহি পাগলী এখানে কবে এসেছে তা কেউ ঠিক করে বলতে পারে না। স্টেশনে কত পাগল-পাগলীইতো আসে যায়, কার খোঁজ কে রাখে! তবে অতি উৎসাহিত অনেকের ধারণা সে এসেছে তিন থেকে চার বছর আগে। বাড়ি ঘর কোথায় তা কেউ জানেনা। জানার উপায়ও নেই। কারণ সে বোবা; কথা বলতে পারে না। অনেকের বিশ্বাস ভারত সরকার বর্ডার দিয়ে এদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ বলে, পাগলীটার ভাব দেখে মনে হয় তার বাড়ি পাহাড়ী এলাকায়; নিশ্চয় উপজাতী। আসলে কার কথা সঠিক তা জানা যায়নি আজও। পাগলীটার নাম যে রুহি তারইবা গ্যারান্টি কী? ওর নাম কোহিনুর, শাহীনুর, মুহিনুর কিংবা অন্য কিছুতো হতে পারে। রুহি নামটা কিভাবে প্রচলিত হলো? তবে সেকি নিজেই বলেছে তার নাম? কবে, কখন বলেছে? কে প্রথম শুনেছে? এমন প্রশ্ন স্টেশন সংলগ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খায় প্রতিনিয়ত।

দু’দশ মাইলের মধ্যে জনবহুল স্টেশন যে নেই তা নয়। নওয়াপাড়া আর যশোর রেল স্টেশন খুব জনবহুল। রুহি কেন সেসব স্টেশন বাদ দিয়ে এই জনশূন্য স্টেশনে পড়ে আছে তা বোঝা যায় না। হাতে গোনা যাত্রীদের কাছ থেকে যা যৎসামান্য পায় তা দিয়েই চলে তার দিন। রাত হলেই টিন শেডের নিচে ময়লাযুক্ত চটের বস্তা গায়ে জড়িয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে থাকে। সকালে উঠে যথা নিয়মে পুরোনো কাগজ কুড়িয়ে জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া আর যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো তার কাজ। এভাবেই চলছে দিন-মাস-বছর।

      দেখে বোঝা যায় বয়স ত্রিশ ছাড়িয়েছে বেশ আগেই। গোলগাল মুখের গড়ন। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের। উসখো খুসকো লালচে বর্ণের চুল; যা মাজা অবধি নেমে গেছে। চোখ দুটো এমন কালো যে, সব সময়ই মনে হয় কাজল দিয়েছে তাতে। মাথায় শ্যাম্পু-গায়ে সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে চুলে সুগন্ধি তেল দিলে গেরস্থ ঘরের বউ বলে ভুল করবে যে কেউ।

জঙ্গলবাঁধাল স্কুলমাঠে লোকে লোকারন্য। স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তি ছাড়াও উৎসাহিত লোকের ভীড় চোখে পড়ার মত। খালঘাটের ফটিক চাঁদের মেয়ের সাথে আতর আলী ছেলের সম্পর্কের বিষয়টা জানাজানি হবার কারণে সালিস বসেছে। সারি সারি তিনটি চেয়ার পাতা। একটা চেয়ারে সালিশের মাতব্বর জব্বার মুন্সী। আর দু’টিতে স্কুলের হেড মাষ্টার ভূপতি পাড়োয়াল আর মসজিদের ঈমাম মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস ফকির বসে আছে। প্রত্যক্ষদর্শী বিভিন্ন মানুষের বক্তব্য শুনে মসজিদের ঈমাম মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস ফকির বলে ওঠে, নাউজুবিল্লাহ। এত্ত বড় অপরাধ আল্লাহ সহ্য করবেন না। আমরা যদি সঠিক বিচার না করতে পারি তাহলে আখিরাতে কোন জবাব দিতে পারবো না। এ গ্রামে আল্লাহর গজব নাজিল হবে। তার কথায় মাতব্বর আর হেড মাষ্টার সাঁই দেয়। ঠিকইতো, এর চেয়ে আর বড় অপরাধ আর কি হতে পারে! সালিসে মাতব্বর জব্বার মুন্সী হুকুম দেয় উভয়কেই বিশটা করে বেত্রাঘাত করে জুতার মালা গলায় পরিয়ে পুরো গ্রাম একবার ঘুরিয়ে আনার জন্যে। রায় ঘোষণার পর অতি উৎসাহিত কিছু যুবক ছেলে ‘অপরাধী’ দু’জনকে বিশটি করে বেত্রাঘাত করে পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে শুদ্ধ করায়। তারপর যার যার অভিভাবকের হাতে তুলে দেয় তাদের।

রাত দশটার ট্রেন পেরিয়ে গেছে আরো আধাঘন্টা আগে। সালিস শেষ করে জব্বার মুন্সী আর রণজিৎ পাল জুয়ার আসরে যাবার জন্যে রওনা হয়। তারা মিনিট কয়েকের মধ্যে স্টেশনের কাছে চলে আসে।

জ্যোৎস্না রাত। রুহি পাগলী প্লাটফর্মের পাশে শিশু গাছের নিচে আপন মনে বসে আছে। জব্বার মুন্সী আর রণজিৎ পাল সেখানে এসে দাঁড়ায়। পাগলীটা উঠে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারায় কিছু চায়।

জব্বার মুন্সী বলল, খাবি?

রুহি পাগলী সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়।

-সত্যি খাবি?

রুহি পাগলী হুঁ বলে মাথা ঝাঁকিয়ে এক পা এগিয়ে যেয়ে খাবারের জন্যে তাদের সামনে দু’হাত মেলে ধরে। জব্বার মুন্সী রুহি পাগলীর দুই হাত চেপে ধরে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে রণজিৎ পালকে উদ্দেশ্য করে বলে, তোমার কোন আপত্তি নেই তো?

রণজিৎ পাল মৃদু হেসে বলল, আপত্তি থাকবে কেন? চলেন সাইডে নিয়ে যাই।

দু’জনে রুহি পাগলীকে খাবারের লোভ দেখিয়ে পাশের কলাবাগানে নিয়ে যথেচ্ছা ব্যবহার শেষে হাতে দশ টাকার দুটো নোট গুজে দিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। সকালে মালো পাড়ায় একটা সালিশ রয়েছে। তাদের সকাল সকাল ঘুমাতে যাওয়া দরকার।

আষাঢ়ের শেষ। ঝড়ের মাতম এখনও শেষ হয়নি। ভোর থেকেই তার আভাস পৃথিবী জুড়ে; সহজে থামবে বলে মনে হয় না। এখন বৃষ্টির কোন ধরা বাধা নিয়ম নেই। সকালে ফর্সা তো বিকেলে বৃষ্টি, বিকেলে বৃষ্টি তো সন্ধ্যায় আকাশ পরিষ্কার। সৃষ্টিকর্তাযে কেন এমন করে তা বুঝ আসেনা মাতব্বর জব্বার মুন্সীর।

আজ বারুই পাড়ার আমজাদ জমাদ্দারের মেয়ের সাথে প্রতিবেশি একজনের মন দেওয়া নেওয়ার বিচার হবে আকাশ পরিষ্কার হলেই।

গত দু’দিন ধরে অন্তসত্ত্বা রুহি পাগলী ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ে আছে স্টেশনের এক কোনায়। তার আত্মচিৎকারে মাঝে মাঝে পুরাতন স্টেশনের বাতাস ভারী হলেও কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। রাস্তার পাশে বেওয়ারিশ কুকুর ঘেউ ঘেউ করলে সভ্য মানুষ যেমন তার দিকে ফিরেও তাকায় না ঠিক তেমনি অবস্থা রুহি পাগলীর। দশ মাস পার হয়েছে গতকাল। ব্যথার যে লক্ষণ তাতে দু’এক দিনের মধ্যে বাচ্চা ডেলিভারী হবে।

পাগলী না হয়ে যদি গ্রামের সুস্থ স্বাভাবিক কেউ হতো তাহলে হাসপাতাল- ডাক্তার না হোক অন্তত একজন দাই তার পাশে থাকতো। এখানে দাইতো দূরের কথা পাগলীটার মুখে একটুকরো দানা পানি পর্যন্ত পড়েনি গত দু’দিন।

রুহি পাগলীর প্রতি ঘৃণায় তাকে কেউ খাবার দেয়না। অনেকে তাকে এই স্টেশন থেকে দূর করে দেবার কথা তোলে। তাদের কথা, রুহি পাগলী এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে। সে এলাকায় থাকলে এলাকার অমঙ্গল হবে- আল্লাহর গজব নাজিল হবে; এলাকার যুবসমাজ বিপথে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

কয়েক বছর ধরে এখানে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। অনেক পাগলীই এ স্টেশনে এসে মায়ের মর্যাদা নিয়ে চলে গেছে অন্য কোথাও। রুহি পাগলীও বছর দুই আগে এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল। সেবারও কারো না কারো দ্বারা অন্তসত্ত্বা হয়ে এভাবেই ব্যথায় ছটফট করেছিল স্টেশনে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর এলাকার লোকজন অবৈধ সন্তান জন্ম দেয়ায় শাস্তি স্বরূপ তার চুল কেটে দিয়েছিল। বাচ্চাটা মাসখানেক পরে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সেদিন রুহি পাগলীর কান্নায় পৃথিবীটা হয়তো ক্ষণেক সময় মোচড় দিয়ে উঠেছিল। এলাকার লোকজন নদীর ধারে বাচ্চার মৃতদেহ মাটি চাপা দেয়। রুহি পাগলী এখনও মাঝে মাঝে সেখানে যেয়ে নীরবে চোখের জল ফেলে; আর বিড় বিড় করে কিছু বলে। হয়তো সৃষ্টিকর্তার কাছে কিছু চায়-কিছু অভিযোগ করে যা কেউ বোঝে না।

আকাশ ফর্সা হয়ে গেলেও রুহি পাগলী ব্যথায় সবকিছু অন্ধকার দেখে। সে চিৎকার করতে করতে অচেতন হয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পরে প্রাকৃতিক নিয়মে যখন নিষ্পাপ বাচ্চাটা আলোর মুখ দেখে কেঁদে ওঠে তখন আমজাদ জোমাদ্দারের মেয়ের বিচারে ব্যস্ত মাতব্বর জব্বার মুন্সীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *