জুয়াড়ি আহমদ রাজুজুয়াড়ি আহমদ রাজু

এ দানেও হেরে যায় নুরুদ্দি। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ টাকা বেশি এনেছিল। মনে বলও ছিল তেমন, ঠিক টাকার মতো। অন্তত তিনগুণ টাকা সে আজ জিতবেই। অথচ চোখের পলকে কেমন যেন সব দান হারতে হয় প্রতিপক্ষের কাছে। নুরুদ্দি কাকুতি মিনতি করে, ‘আমাকে আর একটা দান সুযোগ দাও; কাল শোধ করে দেবো।’

জুয়াড়ি হলেও ঈমান আছে লোকগুলোর। ওসমান গণি লুঙ্গির খুঁট থেকে পাঁচশত টাকার একটা নোট বার করে নুরুদ্দির হাতে দিয়ে বলল, ‘এই টাকাটা কিন্তু তোমাকে ধার হিসাবে দিলাম, কালকে খেলতে এসে আগে টাকাটা শোধ করে দিবা।’  টাকা হাতে নিয়ে নুরুদ্দি বলল, ‘ও নিয়ে তোমার কোন চিন্তা করতে হবে না, কাল এসে আগেই তোমার টাকা শোধ করে তারপর তাসে হাত দিবানে।’

নুরুদ্দির মনে বল প্রচন্ড।

সে ভাঙবে তবুও মচকাবে না। আজকে সে তিন হাজার টাকা নিয়ে বসেছিল জুয়া খেলায়। সব ফতুর হয়ে শেষে পাঁচশত টাকা ধার করে খেলা শুরু করেছে। এ দানে জয় তার হবেই এমন বিশ্বাস মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে।

জব্বার ওসমান গণির উদ্দেশ্যে বলল, ‘কই মিয়াভাই তাস বাটো। ভোর হতে চলল। বাড়িতো যাওয়া লাগবে না নাকি?’

‘দাঁড়াও। তাসগুলো একটু সাজাতে দাও।’ বলল ওসমান গণি।

এক এক করে সব তাস ফেলা হয় চারজনের সামনে। তারা তাসগুলো উঁঠিয়ে যার যার চোখের সামনে তুলে ধরে দেখে কার ভাগ্যের কেমন অবস্থা। নুরুদ্দিও বিজ্ঞ খেলোয়াড়ের মতো চোখের সামনে নিয়ে খুঁটে খুঁটে দেখতে থাকে তাসগুলি। মন বিষণœতায় ভরে ওঠে তার। না; তেমন কোন তাস নেই যা তার অনুকুলে। আবারও ফতুর! তাস মাটিতে ফেলে উঠে দাঁড়ায় সে। নুরুদ্দির ওঠা দেখে অন্য সবাই উঠে দাঁড়িয়ে পরনের কাপড় ঝাড়ে। ওসমান গণি হ্যারিকেনের বাতি নিভিয়ে ঝোপের আঁড়ালে রাখে, যাতে দুরন্ত ছেলেদের নজরে না আসে। জব্বার সেদিকে টর্চের আলো ফেলে। ওসমান গণি হাতের ঘড়ির ওপর টর্চের আলো ফেলে বলল, ‘ওরে বাবা; রাততো অনেক হয়ে গেলো! চলো তালি বাড়ির দিকে যাওয়া যাক।’

প্রতি রাতে নির্ঘুম রাত কাটে নেহার। সে অপেক্ষা করে বাবা ফিরে আসার। এক মুহূর্তের জন্যে চোখের পাতা এক করতে পারে না। তার বাবা ফিরে আসে মাঝ রাতে কিংবা শেষ রাতে। এভাবে চলছে অনেকদিন। কবে থেকে এই নিয়ম শুরু হয়েছিল তা জানা নেই নেহার। তবে তার মনে আছে যেদিন তার মা এই দুনিয়ার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শণ করে অন্য জগতে চলে গিয়েছিল। সেই থেকে এই অপেক্ষা। মা বেঁচে থাকলে বোধ হয় এভাবে নেহাকে অপেক্ষা করতে হতো না বাবার জন্য। তার মা-ই অপেক্ষা করতো। তবে কী মা অপেক্ষার ভয়ে চলে গেছে ওপারে? মাঝে মাঝে নেহার মনে প্রশ্ন জাগে, যা সে কাউকে বলতে পারে না। ইদানিং প্রায় রাতে মার কথা মনে পড়ে। মায়ের সেই কষ্টমাখা মুখ এখনও চোখের সামনে ভাসে নেহার। বাবার অত্যাচারে অতিষ্ঠ মাকে কখনও হাসতে দেখেনি সে।

বাবার আয় কম ছিলোনা। তবুও সংসারে অভাব লেগেই থাকতো। যা আয় করতো তার নিরানব্বই ভাগ জুয়া খেলে হেরে ঘরে ফিরতো মাঝ রাতে। ঘরে তেল নেই, নুন নেই এসব কথা বলতে গেলে মায়ের ওপর চলতো অমানবিক অত্যাচার। চার পাঁচ বছরের নেহা চেয়ে চেয়ে দেখতো সেসব দৃশ্য; আর কেঁদে বুক ভাসাতো মায়ের সাথে। মা তাকে কতবার বুকে জড়িয়ে ধরে বোঝাতে চেয়েছে, ‘সংসার করতে গেলে এমন একটু আধটু হয়েই থাকে তার জন্যে কান্নার কী দরকার। আমিতো কাঁদছি না।’ নেহা মায়ের বুকে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো আর তার মনের ভেতর পুরুষ জাতির ওপর ঘৃণা জন্মাতো। যে ঘৃণা সে মনের ভেতর পুষে রেখেছে আজীবন।

মাঘের মাঝামাঝি সময়। কনকনে শীতে দেশের দক্ষিণাঞ্চল কাবু। সুরভী বিবি অপেক্ষায় থাকে স্বামীর। সে বাড়ি ফিরবে কখন। ঘরে চাল-ডাল কিচ্ছু নেই। ক্ষিদের জ্বালায় ছটফট করে নেহা। সে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুরভী বিবি মেয়ের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে চোখের পানি ফেলে আর সময় গোনে।

নুরুদ্দি যখন বাড়িতে ফেরে তখন রাতজাগা পাখিরা ডেকে ওঠে পাশের হরিতকি গাছে। নুরুদ্দির কাশির শব্দ শুনে সুরভী বিবি হ্যারিকেনের আলোর তেজ বাড়িয়ে দরজা খোলে।  নুরুদ্দি ঘরে ঢুকে বলে, ‘দে খেতে দে; ঘুম আসছে।’

‘আপনার কী কোন আক্কেল জ্ঞান আছে? ঘরে কী একটা চালও আছে যে আমি তাই রাঁধবো? মেয়েটা ক্ষিদের জ্বালায় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।’ চোখে জল এসে যায় তার।

‘চাল নেই তা আমাকেতো বলতে পারতিস।’ বলল নুরুদ্দি।

‘বলবো; আপনাকে! পেলেতো। আপনি সন্ধ্যা হলেই দোকান বন্ধ করে জুয়া খেলতে চলে যান। আপনাকেতো বলেছি যা করবেন করেন, অন্তত বাড়ির বাজারটা ঠিকমত করে দিয়ে করেন।’

‘বাজার করবো; পয়সা লাগেনা? এমনিতো বর্তমানে বেচাকেনার অবস্থা ভালো যাচ্ছে না।’ গায়ের শার্ট খুলে আলনায় ঝুলাতে ঝুলাতে বলে নুরুদ্দি।

‘বেচাকেনা ঠিকমত হয় না তাহলে নিয়মিত জুয়া খেলেন কিভাবে? ও কাজে অন্য কেউ টাকা দিয়ে যায়?’ চোখে মুখে রাগ এবং হতাশার ছাপ ফুঁটে ওঠে সুরভী বিবির।

‘কথা কম বলবি? আমার বুঝ আমার কাছে।’

‘কী বুঝ যে তাতো আমি জানিই। ওসব ছাইপাস খেলা বাদ দেন। এখনও সময় আছে ভালো পথে ফিরে আসেন।’

‘কী বললি? আমি খারাপ?’ চিল্লিয়ে ওঠে নুরুদ্দি।

স্বামীকে সামলাতে চেষ্টা করে সুরভী বিবি। বলল, ‘আপনি খারাপ তা বলিনি। বলেছি আপনার ঐ জুয়া খেলার কথা।’

এই শেষ কথা। আর কোন কথা মনে নেই নেহার। তারপর ঘরের পেছনের আমগাছে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় সুরভী বিবিকে। হয়তো সেদিন সকালে নয়তো অন্য কোনদিন ঠিক মনে নেই নেহার। শুধু স্পষ্ট মনে আছে সেই আমগাছ, উত্তর দিকে চলে যাওয়া লম্বাটে ডাল, তার মাঝখানের ঝুলন্ত সোনালী রঙের পাটের দড়ি।

দিন যতই পার হয় ততই নেহার চোখের সামনে শিশির বিন্দুর মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে কেন তার মা আত্মহত্যা করেছিল কিংবা তাকে হত্যা করা হয়েছিল। অনেকদিন অতিক্রম হয়েছে। নেহা শিশু থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করেছে। নুরুদ্দির পরিবর্তন হয়নি আজো। বরং বেড়েছে। নেহার মা বেঁচে থাকতে মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ করতো জুয়া খেলার। নেহা করে না। সে বাবার মুখোমুখি হয়নি কোনদিন।

ঘরে চাল থাকলে রান্না হয়, না থাকলে হয় না। না খেয়ে কাটিয়ে দেয় পুরোটা দিন। তাছাড়া বাবাকে তার জীবনে কোন কাজে লাগবে বলে মনে হয়না নেহার। যখন মায়ের মৃত্যুর কথা, বাবার জুয়াড়ি জীবন আর তার বর্তমান ভবিষ্যতের কথা মনে হয়, তখন দু’চোখ জলে ভরে ওঠে নিজের অজান্তে। সে চোখ মোছে। আবার চোখ জলে ভরে যায়। এমনি করে চোখের জলের সাথে নেহার যুদ্ধ চলে প্রতিনিয়ত।

ইচ্ছে করলে বাবার মুখোমুখি হতে পারতো, নিজের অধিকার চাইতে পারতো। বলতে পারতো, ‘আমি তোমার মেয়ে বাবা। আমারও অধিকার আছে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার; স্বপ্ন দেখার।’ বলেনি কোনদিন। আর আগামীতেও বলবে বলে মনে হয় না। নেহা মাঝে মাঝে ভাবে- অনেকের বাবা মা দুজনের কেউ নেই। তারতো বাবা আছে। ভালো হোক মন্দ হোক বাবাতো? এটাইবা কম কীসের?

বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে মায়া হয় নেহার। মানুষটার জীবনের সাথে কেন জুয়া খেলা জড়িয়ে আছে অক্টোপাসের মতো। কী আছে ঐ খেলায়? কেমন করে খেলার জন্যে ভুলে যায় সংসারের কথা- মেয়ের কথা। ইচ্ছে করলে ঐ পথ থেকে ফিরে আসতে পারে, বাবা কেন তা করে না ইত্যাদি।

নিঝুম রাত। প্রতিবেশিরা সবাই ঘুমে অচেতন। নেহা বাবার অপেক্ষায় থেকে থেকে কখনযে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি। নুরুদ্দির ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায় নেহার। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে দরজা খুলে দেয়।

নুরুদ্দি ঘরে ঢুকে বলল, ‘আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো। খাবার কি আছে তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। ঘুম পাচ্ছে খুব।’

নেহা কোন কথা বলে না। সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে নিচের দিকে তাকিয়ে।

‘কী রে; কোন কথা বলছিস না কেন?’ প্রশ্ন নুরুদ্দির।

নেহা মুখ খোলেনা তবুও। সে যেভাবে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।

নুরুদ্দি রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে, ‘কী হলোরে কথা বলছিস না কেন?’

মুখ খোলে নেহা। ‘ঘরে কী কিছু আছে যে, তাই রান্না করবো?’

বিস্ময় বোধ নুরুদ্দির চোখে মুখে। বলল, ‘ক্যান চাল-আটা কিচ্ছু নেই?’

না সূচক মাথা নাড়ে নেহা।

নুরুদ্দি কোন কথা না বলে পকেটের ভেতর হাতড়ায়। হাতে কিছু ঠেকে না। সে পকেট থেকে হাত বের করে বিড়বিড় করে বলে ওঠে, ‘কাছে কোন পয়সাও নেই। থাকলে না হয় মোড়ের মাথার সামছের দোকানদারকে ডেকে তুলে কিছু কিনে আনা যেতো। ঘুমের থেকে ডেকে তুলে বাকী নেওয়াও সম্ভব নয়।’ সাত পাঁচ ভেবে কোন কূল কিনারা করতে পারে না নুরুদ্দি। সে নেহার উদ্দেশ্যে বলল, ‘তুই কী কিছু খায়ছিস?’

কোন কথা বলে না নেহা। সে নিশ্চুপ।

মেয়ের এই নীরবতা দেখে বুঝতে বাকী থাকে না সকাল থেকে মেয়েটার পেটে দানাপানি পড়েনি। বলল, ‘দেখি কোন ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। ঘর থেকে বের হবার জন্যে পা বাড়ায় নুরুদ্দি।

     নেহা মুখ খোলে। বলল, ‘এই ভোররাতে কোথায় যাবেন? সামান্য রাতটুকু দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে।

‘তুই একটু অপেক্ষা কর। আমি নারকেল গাছ থেকে একটা নারকেল পেড়ে নিয়ে আসি। রাত উপোষ থাকা ঠিক হবে না। নারকেল হলেও অন্তত পেটে কিছু পড়বে।’

নেহার নিষেধ উপেক্ষা করে নুরুদ্দি ঘর থেকে বেরিয়ে যেয়ে দুটো নারকেল পেড়ে নিয়ে আসে কিছুক্ষণের মধ্যে। ঘরের মেঝেয় রেখে একটা নারকেল ভেঙ্গে নেহার হাতে দেয় অর্ধেক।

‘খা; বেশ মিষ্টি নারকেল। গ্লাস ভর্তি নারকেলের পানি নেহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘পানিটুকু আগে খা।’

নেহা বলল, ‘না আব্বা। আপনি খান। আমি নারকেল খাচ্ছি।’

‘না তুই খা; পানি আমার খাতি ভালো লাগে না।’

‘আপনি একটু খান। আমি অত খাবো না।’

মৃদু হাসে নুরুদ্দি। সে গ্লাসে চুমুক দিয়ে মেয়ের দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দেয়।

সন্ধ্যা ঘোর ঘোর। কিছুক্ষণ আগে মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। হাতে বাজার ভর্তি ব্যাগ নিয়ে নুরুদ্দি বাড়িতে ফেরে। নেহার হাতে বাজারের ব্যাগ দিয়ে বলল, ‘রান্না করতি লাগ আমি আসলাম বলে।’

বাড়িতে বাজার দিয়ে এসে জুয়ার আসরে বসে নুরুদ্দি। সারাদিন বেচাকেনা তেমন একটা হয়নি। সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির কারণে এই বিপত্তি। সে দোকানের ক্যাশ কুড়িয়ে সব টাকা নিয়ে এসেছে জুয়া খেলার জন্যে; যা দিয়ে সে এতদিন ব্যবসা করেছে। আজ তাকে জিততেই হবে। যদি না জিততে পারে কিংবা হেরে যায় তাহলে ব্যবসা করার সব পুঁজি শেষ হয়ে যাবে এক নিমেশে। আগামীকাল থেকে তাকে দিন মজুর খেটে সংসার চালাতে হবে।

নুরুদ্দির দৃঢ় বিশ্বাস, সে জিতবেই। তার হারার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ! মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আজ শেষ জুয়ার কোট। এরপর সে আর কোনদিন জুয়া খেলবে না।

সাদাকালো সংবাদপত্র বিছানো মাটিতে। তার মাঝখানে হ্যারিকেনটা জ্বলছে নির্ভীক। চারিপাশে চারজন তুখোড় জুয়াড়ি। একে একে চারজনের সামনে পড়ে তাসের ঝাঁক।     

নুরুদ্দির সামনে পড়া তাসগুলো তুলে চোখের সামনে ধরতেই বিজয়ের হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে-মনে। এ দান তার। আজ তার বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। সে জিতবেই। পরপর তিন কোট জেতে সে। পকেট ভরে ওঠে টাকায়।

চতুর্থ দান থেকে ঘটে বিপত্তি। পকেট খালি হতে থাকে নুরুদ্দির। দুই চার আট দশ। একসময় পুরো পকেট খালি হয়। নুরুদ্দির চোখে মুখে হতাশা আর অজানা আতঙ্কের ছাপ ফুটে ওঠে। সে মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে থাকে নিঃশব্দে-একা।

নুরুদ্দি ফতুর। খেলতে পারবেনা এক দানও। সে কাকুতি মিনতি করে আর একটা দান খেলার জন্যে। কোন অনুনয়ে কাজ হয়না। বিপক্ষ দলের কারোর দয়া দেখানোর সময় নেই। বিশেষ করে জুয়া খেলায় দয়া দেখানোর মাঝে কোন সওয়াব নেই তা জুয়াড়িরা ভালো করেই জানে। নুরুদ্দির আকুতি, ‘গফুর তুমি একটু দয়া করো। শুধু একবার চান্স দাও।’

‘বোকার মতো কথা বলোনা নুরুদ্দি। জুয়া খেলায় দয়া চলে?’ প্রশ্ন গফুরের।

মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে নুরুদ্দি বলল, ‘তাতো জানি। কিন্তু দয়া মায়া বলোতো একটা কথা আছে।’

‘কিযে বলো নুরুদ্দি। জুয়া খেলায় দয়া দেখাতে হবে কোন হাদিসে এমন কথা লেখা আছে বলেতো মনে হয় না।’

‘হাদিসে নেই তাই বলে……।’

‘তোমাকে একটা চান্স দিতে পারি তাও একটা শর্তে। তুমি যদি রাজি থাকো তাহলে..।’

নুরুদ্দি আগে পাছে কোন কথা না ভেবে বলল, ‘কী কথা? আমি রাজি।’ একটা দান তার খেলা চায়-ই; সে যেকোন মূল্যের বিনিময়ে হোক। একটা দান সুযোগ পেলেই সব টাকা তার পকেটে আবার চলে আসবে বলে বিশ্বাস নুরুদ্দির।

‘শর্তের কথা না শুনেই রাজি হয়ে গেলে নুরুদ্দি?’ প্রশ্ন গফুরের।

নিজেকে সংযত করে নুরুদ্দি বলল, ‘বলো তোমার শর্ত কী?’

গফুর কোন ভূমিকা না দিয়েই বলল, ‘এক দান তোমাকে চান্স দেওয়া হবে; যদি জিতে যাওতো ভালো আর যদি হেরে যাও তাহলে তোমার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিতে হবে।আমি তাকে বিয়ে করবো।’

গফুরের কথায় নুরুদ্দি হতবাক হয়ে যায়। সে বলল, ‘এমন কথা বললে কী করে গফুর! আমার মেয়ে তোমার মেয়ের বয়সী না? মেয়ের বয়সী মেয়েকে নিয়ে…!’ না না; তা হয় না। তুমি অন্য কোন শর্ত দাও।

‘আমার আর কোন শর্ত নেই। তুমি রাজি থাকলে বলো? নয়তো বাড়ি চলো রাত হয়েছে। এই তোরা ওঠ বাড়ির দিকে যাওয়া যাক।’ গফুরের কথায় বাকি দু’জন উঠে দাঁড়ায়।

নুরুদ্দি মনে মনে ভাবে, এবারতো তার নিশ্চিত জয়। আর জয়ী হলে এ শর্ত কোন কাজে আসবে না। ফাঁকে পড়ে হারানো টাকাগুলো নিজের পকেটে ফেরৎ আসবে। সে অনেক ভেবেচিন্তে বলল, ‘বসো আমি রাজি।’

দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় গফুর বলল, ‘নুরুদ্দি ভালো করে ভেবে দেখ। শর্ত ভঙ্গ করার কোন সুযোগ কিন্তু নেই তোমার।’

‘আমি ভেবে দেখেছি। আর ভাববার কিছু নেই। আমার সিদ্ধান্ত পাকা।’

গফুরের সাথে সাথে প্রতিপক্ষরা নিজ নিজ জায়গায় বসে। শুরু হয় চারজনের সামনে তাস ফেলানো। ফেলা শেষ হলে সবাই হাতে তুলে নেয় তাসগুলো একে একে। নুরুদ্দির সামনে ফেলা তাসগুলো চোখের সামনে মেলে ধরতেই মাথা ঘুরে ওঠে তার। সে নির্বাক চেয়ে থাকে গফুরের দিকে।

নেহা রান্না শেষ করে বাবার অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে যায়। সে বাবার বাড়িতে আসতে দেরি দেখে ঘরের দরজা বন্ধ করে হ্যারিকেন হাতে নিয়ে যায় জুয়ার আড্ডায় পোড়া বাড়িতে। যেখানে তার বাবা নিয়মিত জুয়া খেলে। সে পেছন থেকে নুরুদ্দিকে ডাক দেয়, ‘আব্বা বাড়ি চলেন।’

মেয়ের ডাকে নুরুদ্দি তড়িৎ চোখ ফেরায় সেদিকে। হাতের তাসগুলো মাটিতে ফেলে এগিয়ে যায় মেয়ের দিকে। মেয়ের হাত ধরে বলল, ‘এখানে তুই কেন এসেছিস? চল বাড়ি চল।’

বাধ সাধে গফুর। সে শর্তের কথা মনে করিয়ে দেয়। গফুরের পক্ষ নেয় ওসমান গণি আর জব্বার। তারা নুরুদ্দিকে গফুরের প্রাপ্য বুঝে দেবার কথা বলে।

নেহা নিশ্চুপ; কোন কথা বলে না। সে বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে গফুরের হাত ধরে বলল, ‘আপনার প্রাপ্য আপনি বুঝে নেন।’

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে নুরুদ্দি। মুখ থেকে তার কোন শব্দ বের হয় না। সে বসে পড়ে মাটিতে। নেহা গফুরের হাত ধরে যখন আঁধারের মাঝে হারিয়ে যায় তখন নুরুদ্দির চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার জুয়াড়ি জীবন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *